গল্পটি সত্যি কিনা হলফনামা দিয়ে বলতে পারবো না! তবে বিশ্বভারতীর একজন অধ্যাপকের কাছে শোনা: রবীন্দ্রনাথের কলম নাকি প্রায়ই খোয়া যেত । তাঁর গুণগ্রাহীরাই কলম চক্ষুদান করতেন স্যুভেনির সংগ্রেহের অছিলায় ।একবার এক ভক্ত তাঁর কলমটি নিয়ে পালাতে গিয়ে স্বয়ং গুরুদেবের কাছে ধরা পড়ে গেলেন ! নিজের আত্মরক্ষায় ভক্তটি একটি ছড়া শুরু করলেন : ” সকল পক্ষী মৎসভক্ষী মাছরাঙা হয় কলঙ্কিনী!” গুরুদেব ছড়াটি শেষ করার লোভ সম্বরণ করতে না পেরে বললেন : “সবাই কলম ধার করে হায় ! আমিই কেবল কলম কিনি ।”
গরু নিয়ে রাজনীতির কলঙ্ক একটি দলের ঘাড়ে অবশই চাপানো যেতে পারে । কিন্তু বাকি সবাই পরিস্রুত তুলসী পাতা কি? আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে কংগ্রেস রাজনৈতিক দলের নির্বাচন প্রতীক ছিল জোড়া বলদ । তারপর পার্টিতে ভাঙ্গন ধরলো । ইন্দিরা গান্ধী প্রমান করলেন তিনি “গুঙ্গি গুড়িয়া ” (বধির কন্যা ) নন । তিনি একজন বিচক্ষণ নেত্রী । জোড়া বলদ প্রতীক পেলেন আদি কংগ্রেস । ইন্দিরা গান্ধী দূরদর্শী ছিলেন । উনি ভেবে দেখলেন জোড়া বলদ প্রতীকটা বড়ই পুরুষতান্ত্রিক। তাছাড়া পারিবারিক দৃষ্টিকোণ একটু আনলে ভালোই হয় ।তাই তিনি প্রতীক নিলেন গাই /বাছুর। গরুতে ছাপ দিয়ে ভোট তাই বহু যুগ ধরে | অনেক পরে এসেছিলো হাত ।
আরো একটু আগের ইতিহাস । ব্রিটিশরা বলে সিপাহী বিদ্রোহ, আমরা বলি আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ । ১৮৫৭ সালে সেই বিদ্রোহ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।এই মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ভারতীয় সেনাবিহীনতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন। গরুর চর্বি মেশানো কার্তুজ দাঁতে কেটে বারুদ ভরতে হত,ফলে হিন্দু সিপাহীরা ধর্মনাশের আশঙ্কায় বিদ্রোহ করে । নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মঙ্গল পান্ডে ।
কথায় বলে গল্পের গরু গাছে ওঠে । আর গরু নিয়ে আমাদের সাহিত্যে তামাশা আর বিয়োগান্তক গল্পের শেষ নেই । সুকুমার রায়ের “ঝালাপালায় ” ইংরেজির বাংলা অনুবাদ নিয়ে একটি অপূর্ব্য হাস্যকৌতুক আছে :
“কেষ্টা। আজ্ঞে, ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-‘ মানে কি ?
পণ্ডিত। ‘আই’ – ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ – গয়ে ওকার গো – গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাত্ জল – গরুর চক্ষে জল – অর্থাত্ কিনা গরু কাঁদিতেছে – কেন কাঁদিতেছে – না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা – ‘গো ডাউন’, অর্থাত্ গুদোমখানা – গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না – তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে ”
গরু নিয়ে একটি করুণ কাহিনীও আছে । শরৎচন্দ্রের মহেশ ।
কাশীপুর গ্রামের গরিব চাষী গফুর। তার পরিবারের সদস্য বলতে সে, তার মেয়ে এবং একটি গরু যার নাম মহেশ । গফুর যে গ্রামে থাকে, সে গ্রামের হিন্দু জমিদার শিববাবু গরুর প্রতি অবহেলার দায়ে গফুরকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন । তারা গো শব্দের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করে গফুরকে বোঝালেও নিজেরা গরুকে খাওয়ার জন্য খড় দিতে অস্বীকার করে। টাকার লোভে তিনি গ্রামে গরু চরে বেড়ানোর একমাত্র মাঠ বিক্রি করে দেন । গল্পের শেষে একটি ঘটনায় মেজাজ হারিয়ে গফুর তার মহেশকে লাঙলের ফলা দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে, যে মহেশকে সে তার ছেলের মতো ভালোবাসতো ।
গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে গফুর শ্রমিক হিসেবে চটকলে কাজ করতে চলে যায়। কিন্তু যাবার আগে সে একটি মর্মস্পর্শী ফরিয়াদ করে : “নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লা ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।”এই গল্পে হিন্দু জমিদারের গরু প্রেম মেকি আর মুসলমান চাষী একটি গরুকে তার পুত্রসম ভালোবাসে ।
গরুর তক্কো গপ্পো দুধ ছাড়া হয় না । দুধের উৎপাদনে আমাদের দেশ শীর্ষস্থানে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই । ৯১-৯২ -এ আমরা সাড়ে পাঁচ কোটি টন দুধ উৎপাদন করতাম । এখন তা ছুঁয়েছে ২০ কোটি মেট্রিকটনের কাছকাছি । অর্থাৎ ৯১-৯২-এ মাথাপিছু দৈনিক উৎপাদন ছিল ১৮০ গ্রাম, তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০০ গ্রাম। ভারতবর্ষের দুধ উৎপাদনের ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং কিংবদন্তী পুরুষ ভার্গিস কুরিয়েনের নেতৃত্বে কোঅপারেটিভ আন্দোলনের সাফল্য আজ বিশ্বখ্যাত । গরুর দুধ নিয়ে যে রাজনীতি একেবারেই হয়নি তা বলতে পারা যাবে না । মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন : ” (আমি) ইফতারের আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছি। এর জন্য কেউ যদি বলেন, মমতা মুসলিমদের তোষন করে। তারা বলতে পারেন। আমি বলি, যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও একটু আধটু খেতে হয়। যে ডাকবে আমি যাব।” তৃণমূল নেতা জাভেদ খান তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় গরুর গাড়ি বের করে ছিলেন । এসব কিন্তু গরু নিয়ে অহিংস ভোট বাক্সের পলিটিক্স ।
সাম্প্রতিক কালে গরু নিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণ । কোন ছোট পর্দার তারকা বলেছেন নবমীতে বীফ রান্না করি –তাই নিয়ে তুলকালাম । বাড়িতে তিনি কি রান্না করবেন – বীফ না হ্যাম সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত । ফলাও করে তার সঙ্গে দুর্গাপুজো বা ঈদ না জুড়ে দিলেই ভালো হতো । ধর্ম নিরপেক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হিন্দুকে গোমাংস আর মুসলমানকে বরাহমাংস খেতে হবে এমন কোন বিধান নেই । ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শুধু ধর্ম আর রাজ্যপাট পৃথক রাখতে হবে । নেতাজি সুভাষচন্দ্র নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ স্বধর্মপরায়ণ মুসলমান ছিলেন । কিন্তু দুজনেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে ছিলেন অটল ।
গোমাংস কি তাই নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে । আমাদের দেশে মোষের মাংসের চাহিদা অনেক বেশি । গত শতাব্দীত অনেক বনেদি পুজোয় মোষ বলি হতো । ছেলেবেলায় শুনেছি কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের পুজোয় নাকি বলি প্রদত্ত একটি মোষ হাড়িকাঠ উপড়ে সোজা মা দুর্গার কাছে চলে যায় ।তারপর থেকে জমিদারবাবু মোষ বলি নিষিদ্ধ করেন ।
অনেকেই গরুর মাংস ভেবে মোষের মাংস খান । আমার মনে আছে কাঠমান্ডুর ফিরিঙ্গি পাড়া থামেলের একটি রেস্তরাঁয় আমার একজন লন্ডন নিবাসী বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম । বন্ধু সাহেব মানুষ, তিনি স্টেক ফরমায়েশ করলেন । তারপর বললেন অপূর্ব স্বাদ , লন্ডনের যে কোন
স্টেককে হার মানায় । আমাদের হোটেলে ফেরার পথে আমাকে বললেন : “সব ব্যবস্থা অপূর্ব, শুধু মেনুতে বানান ভুল ছিল -বীফ স্টেকের জায়গায় লেখা ছিল বাফ স্টেক ।” আমি সবিনয়ে বললাম : “বানানে কোন গলদ নেই । নেপাল (তখন ছিল )হিন্দু রাজ্য । তাই গো হত্যা নিষিদ্ধ । বাফ হলো বাফালোর শব্দসংক্ষেপ, আপনি মোষের মাংস খেয়েছেন।” আমার বন্ধু সে রাতে আর কোন কথা বলেন নি ।
মোষের মাংস রপ্তানিতে আমাদের দেশ শীর্ষে । দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল । বিশ্বের বাজারে গরু এবং মোষের মাংস রপ্তানির পরিসংখ্যান একসঙ্গে প্রকাশিত হয়ে থাকে । সেই হিসেবে রপ্তানিকারী দেশগুলির ২০২০ সালে এক নম্বর ছিল ব্রাজিল । তাঁরা রপ্তানি করেছেন ২৫.৫ লক্ষ মেট্রিক টন । দ্বিতীয় স্থানে ভারতবর্ষ এবং অস্ট্রেলিয়া । দুটি দেশই ১৪ লক্ষ মেট্রিক টন রপ্তানি করেছে । ভারতবর্ষ থেকে যে “বীফ” রপ্তানী হয় তার ৯০% হলো মোষের মাংস ।
আমাদের দেশে অহিংস গোবেচারা একটি প্রাণীকে নিয়ে সহিংস রাজনীতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে । ২০১৫ সালে গোরক্ষার নামে আখলাখ খানকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল । স্বাধীন ভারতের একজন নাগরিক আখলাখ পাঁঠার মাংস খাবে না গরুর মাংস খাবে তার বিচার সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা করতে পারেন না । যদি সেই অজুহাতে কোনো নাগরিককে হত্যা করা হয় তাহলে আমাদের সমাজ অসভ্য এবং বর্বর আখ্যা পাবে । তাহলে আমাদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের গলা কাটা জিহাদি জন কিংম্বা করাচিতে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের হত্যাকারী আহমেদ ওমর সাঈদ শেখের কি তফাৎ রইলো ? দল, মত, আদর্শ এবং রাজনীতি নির্বিশেষে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে ।
