সাধে কি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন : “এতো ভঙ্গ বঙ্গদেশ,তবু রঙ্গে ভরা !”
এ দেশে রঙ্গের শেষ নেই ! আর বিভাজনের অন্ত নেই ।
স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌল্লা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত নাটকে আবেগভরে বলেছিলেন : “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা, জাতির সৌভাগ্য-সূর্য আজ অস্তাচলগামী; শুধু সুপ্ত সন্তান-শিয়রে রুদ্যমানা জননী নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত । কে তাঁকে আশা দেবে ? কে তাঁকে ভরসা দেবে ? কে শোনাবে জীবন দিয়েও রোধ করব মরণের অভিযান ?”
বিশুদ্ধ বাংলায় এই সংলাপটি যিনি উচ্চারণ করলেন সেই সিরাজদ্দৌল্লার শরীরে একবিন্দু বাঙালি রক্ত ছিল না! তিনি তুর্কি এবং আরবি বংশোদ্ভব ছিলেন । উৎপল দত্ত পরিহাস করে বলতেন -” বাংলা নাটকে শাজাহান এবং ঔরংজেব শান্তিপুরী বাংলায় সংলাপ বলে কিন্তু যেই কোনো ইংরেজ অথবা পর্তুগীজ মঞ্চে আসে অমনি শুরু হয় : “টুমি হামি, টুমি হামি!”
মোগল , তুর্কি, আরব চট জলদি বাঙালি হয়ে যায়, বহিরাগত ইউরোপিয়ানরা বিদেশী থেকে যায় !
তাহলে প্রশ্ন হলো বাঙালি কে আর বহিরাগত কে ?
বিজ্ঞান সাধক আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৪ সালে । বাংলা ভাষার চর্চার জন্য বিখ্যাত রামেন্দ্রসুন্দর জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন না। তাঁর পূর্বপুরুষরা উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছিলেন । পশ্চিম থেকে আসা এই সম্প্রদায়ের মানুষরা রামেন্দ্রসুন্দরের জন্মের দু’শ বছর আগে থেকেই মুর্শিদাবাদে বসবাস করতেন । বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাদের সকলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায় এবং তাঁরা বাঙালিদের মতই বাংলার চর্চা করতে শিখেছিলেন।
প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’ শিরোনামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , ‘হে মিত্র, পঞ্চাশৎবর্ষ পূর্ণ করিয়া তুমি তোমার জীবনের ও বঙ্গসাহিত্যের মধ্যগগনে আরোহণ করিয়াছ আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি। যখন নবীন ছিলে তখনই তোমার ললাটে জ্ঞানের শুভ্র মুকুট পরাইয়া বিধাতা তোমাকে বিদ্বৎসমাজে প্রবীণের অধিকার দান করিয়াছিলেন। আজ তুমি যশে ও বয়সে প্রৌঢ়,কিন্তু তোমার হৃদয়ের মধ্যে নবীনতার অমৃতরস চিরসঞ্চিত। অন্তরে তুমি অজয়, কীর্তিতে তুমি অমর,আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।” রামেন্দ্রসুন্দর কি বহিরাগত ছিলেন, না বাঙালি ?
শান্তিনিকেতনের মোহন সিং খাংগুরা রবীন্দ্র সংগীতের একজন বিখ্যাত গায়ক ! উনি সুদূর লুধিয়ানা থেকে এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে সংগীত সাধনা করতে । থেকে গেলেন । বাংলা ভাষায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি , প্রাণ মাতানো গান -তিনি কি বহিরাগত না নিবেশিত বাঙালি ?অনেকেই বিশ্বাস করেন যে বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় , গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি বাঙালি ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন উত্তর প্রদেশের কনৌজ থেকে ! তাহলে তাঁরা কোন দলে , অনর্গত না কি বহিরাগত ?
এবার আলোচনা করা যাক মাড়োয়ারি সম্প্রদায়কে নিয়ে । মাড়োয়ারিরা রাজস্থানের যোধপুরের মাড়োয়ার অঞ্চলের একটি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সম্প্রদায়। বিখ্যাত জগৎ শেঠ ছিলেন মাড়োয়ারি । ‘জগৎ শেঠ’-এর অর্থ ‘বিশ্ব ব্যাংকার’। ‘জগৎ শেঠ’ একজন ব্যক্তির নাম নয়, এটি বংশগত রাজকীয় উপাধি। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ। আঠারো শতকের শেষভাগে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জগৎ শেঠ পরিবারই ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের অর্থ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো। পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ ১৭ শতকের শেষ দশকে পাটনা থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং সরকারের পক্ষে ব্যাংকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলার দীউয়ান মুর্শিদ কুলী খান ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজস্ব দপ্তর স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদ এ স্থাপন করলে মানিক চাঁদও তাঁর দপ্তর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। সেখানে তিনি নবাবের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও ব্যাংকারে পরিণত হন। জগৎ শেঠ ক্রমে ক্রমে সরকারের একচ্ছত্র ব্যাংকার হিসেবে নিজের স্থান করে নেন। সমস্ত মাড়োয়ারি সম্প্রদায় ছিলেন বাংলার অর্থনীতির একটি অবিভাজ্য অঙ্গ ।
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট সদস্য বিজয় সিংহ নাহার ছিলেন এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি । তিনি জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ শহরে এবং অনেক তথাকথিত বাঙালি ভদ্রলোকের থেকে ভালো বাংলা বলতেন । তিনি যদি বহিরাগত হন , তাহলে কে যে বহিরাগত নয় আমি জানি না ।
আপনি বাঙালি না অবাঙালি – -এই লিটমাস পরীক্ষা কি ভাবে হবে ? বাবা যদি বাঙালি হন আর মা অবাঙালি তাহলেই কি শুধু পুত্র বা কন্যা বাঙালি হবেন ? যদি তাই হয় তবে নোবেল পুরস্কার জয়ী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি খাঁটি বাঙালি যদিও তাঁর মা মারাঠি ! কিন্তু বিখ্যাত গায়ক অভিজিৎ সিং (যাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে) তিনি কি তাহলে বাঙালি নন যদিও তাঁর মা বাঙালি ? রাহুল দেব বর্মন কি বাঙালি না অবাঙালি ? আমাদের সাংসদ এবং আমার স্কুলের ছাত্র ডেরেক ওব্রায়েন তো ঝরঝরে বাংলা বলেন -তিনিও কি তাহলে অবাঙালিদের দলে পড়বেন ? বাংলা রেনেসাঁর হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও বহিরাগত ? সন্ত তেরেসা এসেছিলেন ম্যাসেডোনিয়া থেকে । সারাজীবন দরিদ্রের সেবা করেছেন কলকাতায়,শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন এই শহরে , তিনি কি বহিরাগত ?
কলকাতা এবং অবিভক্ত বাংলা এক সময় ছিল ভারতের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু । আমাদের পাট, চা শিল্প এবং অন্যান্য কারখানা গুলি ছিল বিহার এবং উত্তর প্রদেশ থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল । সরকারি এবং সওদাগরি সংস্থায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ কলকাতায় এবং বাংলায় আসতেন । এই সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বিভিন্নতা ছিল বাংলার কৃষ্টিগত উৎকর্ষ এবং আর্থিক ঐশ্বর্যের উৎস ! আমাদের রাজ্যে এবং শহরে বাসা বেঁধে ছিলেন বাগদাদ থেকে আগত ইহুদিরা , অত্যাচারিত আর্মেনিয়ানরা , আইরিশ , আমেরিকান , ফরাসি , পর্তুগিজ এবং আরো অনেকে।
পশ্চিম বাংলা স্বাধীন ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য । ভারতের সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী যে কোনো নাগরিক দেশে অবাধ বিচরণ করতে পারে ।আমি আগামীকাল গুজরাতে গিয়ে ব্যবসা বা চাকরি করতে পারি, বসবাস করতে পারি । তেমনি তামিলনাড়ু থেকে একজন এসে পশ্চিমবাংলায় চাকরি করতে পারেন কিংবা ব্যবসা -কোনো বাধা নেই । যদি কেউ বলে -তুমি বহিরাগত , চলে যাও , তাহলে সে বেআইনি কথা বলছে এবং তা দণ্ডনীয় অপরাধ ।
একটু ভেবে দেখুন সিলিকন উপত্যকা কেন এতো প্রাণবন্ত ? কেননা সানফ্রান্সিস্কো মেধা এবং পুঁজিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে । কেউ সেখানে প্রশ্ন করে না -তুমি কি বহিরাগত না স্থানীয় ? সেখানে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে মেধাবী মানুষ জড়ো হয়েছে -আমাদের ভারত এবং পশ্চিম বাংলা থেকেও । সেখানে চলছে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনীর মহাযজ্ঞ আর পূজারীরা আসছে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে !
যদি সেই বাজার অর্থনীতির যজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হয় তাহলে প্রাচীর ভাঙতে হবে । “বহিরাগত” দের সেই মহাহোমের ঋত্বিক হিসেবে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে । শুধু চিত্ত ভয়শূন্য হলেই চলবে না । জ্ঞানকে মুক্ত করতে হবে,গৃহের প্রাচীরকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং আহ্বান করতে হবে দেশি এবং বিদেশী পুঁজি এবং মেধাকে। যাঁরা বাংলা ছেড়ে অন্য রাজ্যে কিংবা বিদেশে গিয়ে সফল হয়েছেন তাঁদের অবাধ লগ্নির সুযোগ দিতে হবে । আমরা যদি এখন কে খাঁটি আর নির্ভেজাল বাঙালি নিয়ে কূটকচালি শুরু করি তাহলে সরস্বতী (মেধা) এবং লক্ষ্মী (পুঁজি) দুই দেবতাই অপ্রসন্ন হবেন । ফল: বাংলার ভূত এবং অতীত , ভবিষ্যতের থেকে উজ্জ্বল দেখাবে ।
